সাহিত্য বাগান-এর ওয়েব ম্যাগাজিনে (জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস) আগষ্ট সংখ্যায় মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন'র রচিত গল্প --
সালামের দেশপ্রেম
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন
"মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি"- গোবিন্দ হালদার রচিত কালজয়ী গানটি বাংলার আকাশে বাতাসে চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে। আর বাংগালীর লোম শিউরে উঠছে। আগামীকাল ২৬ মার্চ। বাংগালীর জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র নিরীহ বাংগালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। শুরু হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বীর বাংগালীরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। রচিত হয় নতুন ইতিহাস। আজকের শিশু-কিশোররা সেই ইতিহাস পড়ে আর তাদের শরীরের রক্ত টগবগ করে ফোটে। আফসোস করে কেনো তখন আমার জন্ম হয়নি। এটাই দেশপ্রেম।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী চলমান। বাংলাদেশ সরকারও সারাবছর ব্যাপি বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। স্কুলে স্কুলে চলছে বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতা। আমার পাশের বাড়ীর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী সালাম খুবই মেধাবী। সে এবছর 'বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ' বিষয়ের উপর একক অভিনয় করে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ১৭এপ্রিল পুরস্কার গ্রহণ করবে। তার কারণে এখন তার গরীব পিতা-মাতাকেও সবাই চেনেন। গর্বে তাদের বুক ভরে গেছে। তাকে নিয়ে আমারও গর্বের শেষ নাই। আমিও যে তার এই অভিনয় দক্ষতাকে প্রস্ফুটিত করতে নানাভাবে সহায়তা করেছি। তার বাবার কথা, আমার ছেলের পুরস্কার আনতে আপনাকেই যেতে হবে। আমি এজন্য মনে মনে অনেক খুশি হয়েছি। আসলে সালামকে আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সব বিষয়ে গাইড করছি। সকাল-সন্ধ্যা আমার কাছেই আসে পড়ার জন্য। এছাড়াও যেকোনো সমস্যা হলেই আমাকে বলে। আমিও নির্দ্বিধায় তার সমস্যার সমাধান করি। কোথায় যেনো একটা মনের টান অনুভুত হয়।
লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধূলা ও শিক্ষামূলক যেকোনো বিষয়ে সালামের সরব উপস্থিতি বিরাজমান। শুধু তাই নয়, পারদর্শিতাও সমান তালে আছে। বিদ্যালয় পর্যায়ের প্রায় প্রত্যকটা ইভেন্টেই সে কোনো না কোনো অবস্থানে থাকে। এজন্য সে সকলেরই নয়নের মনি। ক্লাসে সবসময়ই প্রথম স্থান অধিকার করে। আচার-আচরণেও অমায়িক। এক কথায়, একজন আদর্শ শিশু বলতে যা বোঝায়।
সরকার প্রতি বছর প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবছর প্রতিযোগিতা ঘোষণা করলে সালাম প্রায় সকল ইভেন্টে অংশ নেয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে ছয়টি ইভেন্টে প্রথম স্থানসহ নয়টি পুরস্কার অর্জন করে। সন্ধ্যায় এসে আমাকে জানালে ভীষণ ভালো লাগলো। আমি ওকে ফ্রীজ থেকে মিষ্টি বের করে খাওয়ালাম আর উৎসাহ দিয়ে বললাম, এবার কোনো না কোনো ইভেন্টে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আনতে হবে। সালাম হেসে জবাব দিলো, আঙ্কেল, আপনি পাশে থেকে সাহায্য করলে অবশ্যই আমি পারবো। বোকা ছেলে, আমি তো সবসময়ই তোর সাথে আছি, আমি বললাম। ওর চোখে আনন্দ অশ্রু দেখলাম। মনে হয় সে ইতিমধ্যেই জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
সালামকে বুকে টেনে নিলাম। তার কান্না এবার বেরিয়ে এলো বুক ফেটে। ভাঙ্গা গলায় বললো, এগুলো করতে তো অনেক খরচ হয়। আমরা তো গরীব। টাকা পাবো কোথায়। আমি বললাম, ধুর বোকা, কোনো খরচ নাই। যা হবে বিদ্যালয় করবে। তারপরও যদি লাগে তোর এই আঙ্কেল আছে না? বুক থেকে সরিয়ে দুই হাতে চোখের পানি মুছে দিলাম। আবার হাসি ফুটলো ওর চোখে মুখে। বললো, আঙ্কেল দেখেন আমি পারবোই, আমাকে কোনো না কোনো ইভেন্টে যে পারতেই হবে। আমি বললাম, বাবা সালাম, তোমাকে এতোগুলো ইভেন্টে অংশ নেয়া যাবে না। সবগুলোর মধ্যে তোমার যেটা সবচেয়ে ভালো লাগে সেটা বেছে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা করতে হবে। সবগুলোর পিছনে সময় দিলে একটাও হবে না বাবা। সালাম বললো, জী আঙ্কেল, আমি অভিনয় করতে চাই। গুড, আমি বললাম। তবে উপজেলা পর্যায়ে সবগুলোতেই অংশ নাও। জী আঙ্কেল, আমি এবার আসি, এই বলে সালাম তার বাড়িতে গেলো।
আজ রবিবার। আগামী বৃহস্পতিবার উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হবে। সোমবার সকালেই সালাম আমার কাছে হাজির। বললো, আঙ্কেল আমি অভিনয় করবো, আপনি মনোযোগ দিয়ে দেখবেন। পরে কোথায় কোথায় সমস্যা তা বলবেন এবং কিভাবে করতে হবে দেখিয়ে দিবেন। এই বলে অভিনয় শুরু করলো। আমি তো দেখে হতবাক! ভাবাই যায়না, একদম বঙ্গবন্ধুর ডুপ্লিকেট! আমি ওকে দুই একটি জায়গায় শুধু হাতের নাড়াচাড়া দেখিয়ে দিলাম। বললাম, তুমি একক অভিনয়েই জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে, দেখে নিও। ওর দু'নয়ন আনন্দে চিকচিক করছে। অস্ফুট স্বরে শুধু বললো, তাই যেনো হয়। আমি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করতে চাই।
প্রতিদিন তিন-চার ঘন্টা করে সালামের প্রাকটিস চলছে। ড্রেস পরিস্কারসহ লন্ড্রি করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র রেডি। আজ বৃহস্পতিবার, উপজেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতা চলছে। সালাম ইতোমধ্যে দুটি ইভেন্টে উপজেলা চ্যাম্পিয়নসহ চারটি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। এখন বাকী শুধু স্বপ্নের ইভেন্ট, একক অভিনয়। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে শুরু হলো অভিনয়। আমি সালামের সাথেই আছি। একে একে প্রতিযোগিরা চমৎকার চমৎকার পারফর্ম করছে। এবার সালামের পালা। সালাম বীরদর্পে এগিয়ে আসছে মঞ্চে। তার ভিতরে যেনো কোনোই জড়তা-সংকোচ নেই। তার হাঁটায় যেনো বঙ্গবন্ধুরই প্রতিচ্ছায়া সকলের চোখে পড়ছে। কিছু অভিনয় আর ভাষণ যেনো সকলেরই হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। ফিসফিস করে সবাই বলছে, এই ছেলেই উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হবে। কেউ বলছে, না, না, এমনও হতে পারে সে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। আমার ভীষণ খুশি লাগছিলো এসব মন্তব্য শুনে। অতঃপর ফলাফলে সালাম উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হলো। অনেক আনন্দ নিয়ে দু'জনে বাইকে চেপে বাড়িতে ফিরছি। রাস্তায় সালাম বলছে, আমি কি জেলাতে শুধু অভিনয়ে অংশ নিবো? আমি বললাম না, তিনটিতেই নিবে। তবে মনোযোগ আর অনুশীলন অব্যাহত থাকবে অভিনয়ে। বাড়িতে পৌঁছে ওকে বললাম, এখন ফ্রেশ হয়ে খাওয়া করে ঘুমাবে। কোনো চিন্তা করবেনা। জ্বি আঙ্কেল, বলে চলে গেলো।
সালামের ভিতরে উৎসাহ আর উদ্দীপনা যেনো দিনের পর দিন বেড়েই চলছে। মনোবল তুঙ্গে। আমি ওর আগ্রহ দেখি আর মনে মনে পুলকিত হই। প্রতিদিন সীমাহীন পরিশ্রম করছে ছেলেটি। দেখতে দেখতেই জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা ঘনিয়ে এসেছে। পরের দিনই প্রতিযোগিতা হবে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য যেসব উপকরণ লাগবে তার তালিকা আগেই করা ছিলো। তালিকা অনুযায়ী সবকিছুই বিকেলে আমার কাছে জমা দিলো। ঠিকঠাক আছে দেখে আমি বললাম আজ আর কোনো কাজ নয়, পরিপূর্ণ বিশ্রাম নাও ও পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাও। চেহারায় যেনো ক্লান্তির কোনো ছাপ না থাকে। জ্বি, এই বলেই মুচকি হেসে বাড়িতে গেলো।
ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতে একসাথে আদায় করে বাড়িতে ফেরার পথে সালামকে দেখলাম বেশ ফুরফুরে। মনে খুব প্রশান্তি নিয়ে ওকে বললাম, বাবা তুমি বাড়িতে গিয়ে রেডি হয়ে আমার এখানে এসো। একসাথে নাস্তা করে সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে পরবো। কিছু সময় হাতে নিয়েই যেনো আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। বলতে বলতেই বাড়িতেও আসলাম। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো। প্রয়োজনীয় ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার খেয়েই আমরা বাইকে রওনা দিলাম। সাড়ে আটটায় জেলা স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম। ঘুরে ঘুরে কোথায় কোন প্রতিযোগিতা হবে তা দু'জনেই দেখলাম। সকাল দশটায় প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সালাম জেলা পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য তিনটি ইভেন্টে মনোনীত হয়েছিলো। ইতোমধ্যে দুটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে আবৃত্তিতে জেলা শ্রেষ্ঠ ও চিত্রাংকনে ২য় স্থান অধিকার করেছে। এখন চলছে একক অভিনয়। সকলের অংশগ্রহণ শেষে ফলাফলে সালাম আবারো সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে। অর্থাৎ সে এই ইভেন্টেও জেলা শ্রেষ্ঠ হয়ে বিভাগে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়। এমনিভাবেই বিভাগীয় পর্যায়ের জন্যও কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে সেখানেও আবৃত্তি ও একক অভিনয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত হয়।
এবার সালামের প্রস্তুতি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লক্ষ্যে। নিবিড়ভাবে অনুশীলন চলছে দুটো ইভেন্টেই। মার্চের ৭ তারিখে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রত্যেক প্রতিযোগীর সাথে তার একজন অভিভাবক বা শিক্ষক থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রে সালাম আমাকেই নির্বাচন করেছে। ৬ মার্চ বিকেল ৫ঘটিকার মধ্যেই কর্তৃপক্ষের নিকট রিপোর্ট করতে হবে। আমরা রিস্ক না নিয়ে ৫ মার্চের রাতের রংপুর এক্সপ্রেসে সিঙ্গেল কেবিন কনফার্ম করলাম। যথারীতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নির্ধারিত ট্রেনে রওনা দিলাম। সালাম সারারাত নির্বিঘ্নে ঘুমালো।
সকাল সাড়ে আটটায় কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছলাম। আমরা সিএনজি নিয়ে সোজা শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে চলে এলাম। এখানেই জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। আমা রিপোর্ট কলাম। আমাদের বিশ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করলো। ফ্রেশ হয়ে দুজনেই ঘুমালাম। সারাদিন ঘুম আর ছোট ছোট অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সময় পার করা হলো। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম দু'জন।
ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে প্রস্তুতি নিলো সালাম। আটটায় নাস্তা সেরে মাঠে গেলাম। সারাদিন ধরে বিভিন্ন ইভেন্টে প্রতিযোগিতা হলো। সালামের আবৃত্তি প্রতিযোগিতা শেষ। ফলাফল দ্বিতীয়। ওর মনে কোনো আক্ষেপ নেই। আমাকে বলছে, আঙ্কেল, আমি একক অভিনয়ে চ্যাম্পিয়ন হবো। অভিনয় শুরু হলো। একে একে সবাই পারফর্ম করলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শেষদিকে প্রতিযোগিতা পরিদর্শন করতে চলে এলেন। এমন মধুর সময়েই সালামের একক অভিনয় শুরু। সালামকে দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে সত্যিসত্যিই বঙ্গবন্ধু আসছেন। অভিনয়ের সাথে সাথে ভরাট কন্ঠে বক্তৃতা দিচ্ছেন যেন মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নিজেই কথা বলছেন। বঙ্গবন্ধু তনয়া আবেগে আপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। অভিনয় শেষে তিনি সালামকে ডেকে জড়িয়ে আদর করেন। সকলের মুহুর্মুহু করতালিই জানিয়ে দিয়েছিলো সালামের অভিনয়ের সাথে অন্যদের তুলনা হয়না। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে সালাম একক অভিনয়ে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করলো। আগামী ১৭ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে সকল জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রতিযোগীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করবেন। বারিতে সবাইকে মোবাইল ফোনে সুসংবাদ জানিয়ে দিলাম। অতঃপর রাতেই আমরা লালমনি এক্সপ্রেস এ করে বাড়ি ফিরলাম।
বাড়িতে এসে সবাই সালামকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলো। স্কুলে স্যারেরা সকল শিক্ষার্থীদের নিয়ে তার জন্য আনন্দ মিছিল করলো এবং তাকে মিষ্টি খাওয়ালো। সারাদিন সালামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পার হলো। রাতে তাকে বেশ ক্লান্ত মনে হলো। আমি সালামকে রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলে ঘরে চলে আসলাম। রাত দুইটার দিকে সালামের বড় ভাই কালাম আমাকে ডাকছে। জবাব দিতেই বলছে সালামের প্রচন্ড জ্বর। তাড়াহুড়ো করে উঠে গিয়ে জ্বর মেপে দেখলাম ১০৩ ডিগ্রি পার হয়েছে। মাথায় পানি ও শরীর ভিজে কাপড় দিয়ে মেসেজ করতে বললাম। ঘরে থাকা জ্বরের ওষুধ এনে খাওয়ালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্বর ছাড়লে চলে আসলাম।
কয়েকদিন হলো এভাবে অনবরত জ্বরে সালাম বেশ ভেঙ্গে পড়েছে। আমাকে বলছে, আঙ্কেল, আমার মনে হয় আমি আর প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করতে পারলামনা। দেখতে দেখতে মার্চের ১৭তারিখ। কোভিড-১৯ নামে একটা মরণঘাতী ভাইরাস সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করেছে। মনের মধ্যে একটা অজানা আতংক বারবার উঁকি দিচ্ছে যে সালাম আবার কোভিড-১৯ভাইরাসে আক্রান্ত নাতো? সিম্পটমগুলোও যে তেমনি মনে হচ্ছে। ডাক্তারও আমাকে ফিসফিসিয়ে তাই বলছে। আমি বাড়ির সবাইকে একটু সাবধানে থাকতে বললাম। স্যাম্পল দেয়া হলো। ২৪ মার্চ রিপোর্টে নেগেটিভ রেজাল্ট আসায় সবাই খুশি হলো। তখন সালাম বললো, আঙ্কেল, ২৬ মার্চ ভোরবেলা কিন্তু শহীদ ভাইদের স্মরণে আমি স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাবো। ঠিক আছে বাবা, সুস্থ হও, আমিই নিয়ে যাবো, এই বলে আশ্বস্ত করে চলে এলাম।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সালামকে দেখতে গেলাম। অনেকটাই সুস্থ, হাঁটা চলা করছে। হাসতে হাসতে বলছে আমি এখন বেশ ভালো আঙ্কেল। কালাম ভাইকে ফুল কিনে আনতে বললাম। কথা বলতে বলতেই সে ফুল নিয়ে হাজির। কেনা ফুলের সাথে আমার বাগানের ফুল জোড়া দিয়ে নিজ হাতে সালাম সুন্দর একটা তোড়া বানালো। আমাকে বললো, আঙ্কেল, স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় আসবো। ঠিক আছে, ঘুমাও এখন, বলে বিদায় নিলাম।
ভোরে উঠে ওজু করে সালামের ওখানে গেলাম। গিয়ে দেখি সালাম জ্বরে কাঁপছে। আমাকে দেখেই উঠে বসলো। চারিদিকে ধ্বনিত হচ্ছে 'সালাম সালাম হাজার সালাম', 'জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো', 'একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার'-সহ অসংখ্য দেশগান। দেশপ্রেমে কাতর সালাম স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে ব্যাকুল প্রায়। ওর বাবা কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলছে, ভাইজান, চলেন, আমার রিক্সায় করে নিয়ে যাই। কিন্তু সালাম রিক্সায় যাবে না, পায়ে হেঁটে যাবে। নইলে শহীদদের অবমাননা হবে। বাধ্য হয়ে সালামের বাবা আর আমি দু'পাশে ধরে ওর বানানো তোড়াসহ খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই সালামের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো। সালাম বললো, তাড়াতাড়ি চলেন। ওর গায়ে যেনো শক্তি বেড়ে গেলো। দ্রুত হাঁটছে। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম স্মৃতিসৌধ স্থলে। কোনো রকমে স্মৃতিসৌধে উঠতেই ফুলসহ ঢলে পড়লো সালাম। ওর বাবা চিৎকার করে বললো, 'বাবা, তুই এতো নিষ্ঠুর কেনো? কেনো তুই সবাইকে ছেড়ে এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলি? তোর যে এই দেশ ও জাতিকে দেয়ার অনেক কিছুই বাকী রইলো। প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে বহু কাঙ্খিত জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব পুরস্কারও যে তোর গ্রহণ করা হলোনা।'
উপস্থিত জনতা সবাই সালামকে এ অবস্থায় দেখে হতবাক। তার দেশপ্রেম যেনো সকলের নিকট দৃষ্টান্ত হিসেবে রইলো। সবার চোখ অশ্রুতে ছলছল করছিলো। সবাই মিলে ওকে ধরে মাথার উপরে তুলে সমস্বরে গাইতে আরম্ভ করলো, 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি'। অনেক যুদ্ধ করেও বাঁচানো গেলোনা সালামকে। চারপাশে বাতাসও যেনো ভারী হয়ে এলো।
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী।
আরো পড়ুন কবিতা--
চন্দন চন্দ্র মহন্ত--শৈশব কাল
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ -- ( বিধিনিষেধ আরোপ )
মোঃ আব্দুল মান্নান -- ( আমার মা)
মোঃ আজহারুল ইসলাম আল আজাদ -- ( তোর বাবুটা কেমন হবে?)
দীনেশ চন্দ্র রায় -- ( পরাধীনতা ও শিক্ষা )
প্রকাশ চন্দ্র রায়-- ( ছুটে এসে মিশে যাও )
আবু হানিফ জাকারিয়া -- ( মৃত্যুর স্বাদ )
মোঃ আব্দুল লতিফ প্রামাণিক - ( সেই তুমি )
মোঃ মোসফিকুর রহমান - ( গৃহহারা)
সৌরভ রায় - ( ওদের কাঁদালে কেন তুমি? )
আরো পড়ুন গল্প ---
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন -- ( বাংলার রাজকুমার )
মোঃ সাখাওয়াৎ হোসেন -- ( সালামের দেশপ্রেম )
রেজাউল করিম রোমেল - ( অযাচিত প্রেম)
প্রকাশ চন্দ্র রায় - ( রাধানাথ ) প্রচার ও প্রকাশ-- সাহিত্য বাগান