ব্যবচ্ছেদ | সুদাম কৃষ্ণ মন্ডল

 


ব্যবচ্ছেদ(ছোটোগল্প)

সুদাম কৃষ্ণ মন্ডল



   গতকাল থেকে গুমোট হয়ে আছে আকাশ । গরম কিন্তু বৃষ্টি নেই। রেডিও-টিভিতে আবহাওয়া দপ্তরের খবর প্রকাশিত হচ্ছে । হালকা মাঝারী বৃষ্টি হবে। অনেকদিন বৃষ্টিও হয়নি । আষাঢ়ের শেষাশেষি। রথের মেলা এইমাত্র শেষ হলো। জিলেপী  দিয়ে মন  ভুলিয়েছে নাতনির । কাঁঠাল -আম -খেলনা দিয়ে মন ভরলেও বাবার কথা বারে বারে মনে করে ।

        বিজয় ভালোবাসে একমাত্র মেয়েকে। প্রত্যহ খাবার এনে দিত। ঠাকুরমা এখন বাজারে যায় । সকালে সবজি মাছের সাথে যা আনে তার মনে লাগে না । মা বকাবকি করে। আড়ি করে কাঁদলে জেদ ধরে খাওয়ানো যায় না । মায়ের কথায় চিড়ে ভেজে না।  খেলনাপাতি বের করে দিলে ভুলে যায় । মাত্র দুই বছরের মেয়ে সকলের স্নেহাস্পর্শ পেয়ে সে ধন্য । তার ঠাকুরমা আদর করে কোলে নিয়ে বাইরে সেদিন চাঁদ দেখাতে আসে। সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে থাকলেও মেঘের ঘনঘটায় জ্যোৎস্নাহীন হয়ে ঘন অন্ধকারে উঠানময় লেপ্টে আছে । জোনাকি  দপদপ করে ঝিঙের ক্ষেতে বাগান বাগিচায় বেড়ায় ঝোপে । কুনো ব্যাঙ লাফিয়ে  যাচ্ছে দেখে জুজুর ভয় দেখিয়ে শান্ত করায়। পিঠে নিয়ে ঘুম পাড়ালে সে  ঘুমিয়ে পড়ে।

        বিজয় মায়ের ছোট ছেলে । অজয় বিজয় দুই ভাই। অজয় পাশের ঘরে আলাদা।  তার ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে । স্ট্যান্ডার্ড স্কুলে যায়। অজয় কর্মসূত্রে কলকাতায় রেস্টুরেন্টে কাজ করে । সপ্তাহ অন্তর আসে । বিজয় তা কিন্তু নয়।  সে যায় ট্রলারে । মায়ের চিন্তা মনের আকাশে ঘন জমাট বেঁধেছে। কালকে থেকে মনটায় কু গাইছে ।  মেঘ জমে আছে অথচ বৃষ্টি হয়নি।

        রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে ঝড়  । সমানে বজ্রবিদ্যুৎ সহকারে প্রবল মুষলধারে বৃষ্টি।  অনেক দিনের পর বৃষ্টিতে সারা রাতে খাল বিল নদী ভরে গেছে ।  বিজয়ের কথা ভেবে মা সারারাত ঘুমোয়নি। শ্বাশুড়ি বৌমা বারান্দায়  লন্ঠন জ্বেলে বসে বসে বিজয়ের কথা ভাবছে । কত এলোমেলো কথা মন ছুঁয়ে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকালে বাদল মেঘ ভেঙে পড়ার শব্দে শিউরে উঠে পরস্পরে রাম নাম জপতে থাকে । মাঝে তো বিজয়ের মা উঠে বাড়ির কোনায় সিংহাসনে বসানো পীর ঠাকুরকে মানত করে আসলো । "মা গঙ্গা ""মা গঙ্গা " বলে ঘনঘন হাতজোড় করে "রক্ষা করো মা" বলে স্বস্তি পাচ্ছে।  কিন্তু নিয়তি কারো কথা শোনে  না । দেব দেবী তো নিমিত্ত মাত্র ।

                পরদিন ভোর না হতে ওয়ারলেশে খবর পৌঁছে গেল বিজয়দের  ট্রলার মার খেয়েছে । মাঝিসহ সকলে বেপাত্তা । যদিও জাল ফেলেছিল রক্ষা পাবার জন্য । তা শেষ রক্ষা হয়নি । ট্রলার পাল্টি খেয়ে অন্ধকারে গভীর সমুদ্রের ঢেউ সর্বশান্ত করেছে।  সকলের ঘরে কান্নার রোল ।

                        টুম্পা মানে বিজয়ের স্ত্রী শাঁখা সিঁদুর  ত্যাগ করেনি।  ফিরে আসার আশায় আশায় স্ত্রী আর মা পথ চেয়ে থাকে ।

                                টুম্পা ভালবেসে বিয়ে করেছিল বিজয়কে। গরিব জেনেও সে ভালবাসার মর্যাদা ক্ষুন্ন করেনি। কিন্তু বিত্তবান বাবার বাধা উপেক্ষা করে সুখের সংসার গড়তে চেয়েছিল দিন আনা খাওয়ার সংসারে। বিজয়কে হারিয়ে টুম্পা মনমরা ও দিশেহারা ।

                                        মেয়ে শম্পাকে নিয়ে  বাপের বাড়ি চলে আসে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে টুম্পাকে মা বাবা বাধ্য হয়ে বোঝায়  ,  -- তুই আবার বিয়া করিবি দে আরি ।

                                        ----- নঅ । আর আঁই বিয়া নো কইরজ্যুম। আঁর কপালৎ যা আচে হইব দে আরি । আঁর মাইয়া পুয়া কার  ডাগৎ  যাইব? ক্যান বাঁচিব ? কঁঅরতে  যাইয়ারে মরিব ফানলা ?

----  নো মরিব বেডি। তুরার লাই টিঁয়া ফিকস্ করি দিউম । লিখাপরা যতদূর করিলে করিত্তে  পারে। বিয়া শাদীর লাই যা লাগিব দিউম । তয়  আঁরার কথা শুন,তুই আবার বিয়া কর ।

---- উম হুঁ। আঁর কুলর মাইয়াপুয়ার লাই আঁই করি ন্যো পাইজ্যুম । ইতে  আাঁয় ছারা কেঅরে নো চিনে।

-----  চিন্তা করি চা সাঁই । ভালা বর ঘর আইস্যে  তু বিয়া কর । তুঅর মুখর  পানে চাইর নো পারিদ্যে।  

------  আঁয় বুঝায় দুঅ  ত  হিন্দুর মাইয়া পুয়া  কয়বার বিয়ার পিঁড়িৎ বয়ন পরের  ?  আঁর কআল পুরি গিঐ তো গিঐ।  আঁর সোনা মাইয়া পুয়ার  মুখর পানে চাইয়ারে কুঅন মায়র বিবেকে অ্যান কাজ করিব ?

      বাড়ির  অন্তঃপুরে মেয়েকে নিয়ে বাবা-মা খুব বোঝাচ্ছে যাতে সে আবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করে। টুম্পার চোখে জল । জানালার গরাদ ধরে  অঝোর নয়নে  কাঁদছে । হাতের শাঁখা সিঁথিতে  সিঁদুর এখনও আছে । যদি সে ফিরে আসে। সমুদ্রের কথা বলা যায় না ছয় মাস বছর পেরিয়ে গেলেও  অনেক ক্ষেত্রে অনেকে ফিরে এসেছে । সেই সময়টুকুও সবুর করতে দেবে না ।

            বাবা-মার আত্মসম্মানের ভয় । দেখতে সুশ্রী সুন্দরী । দেবী দুর্গার মত চেহারা। সদাহাস্যময়ী মুখশ্রী যার তার গণ্ডদেশে আমৃত্যু অশ্রু গড়িয়ে পড়বে তা চায়নি' কেউই । আবারও  যদি ভুলিয়ে ভাঙ্গিয়ে ওকে সুপথে কুপথে যে কেউ টেনে নিয়ে চলে যায় । কিন্তু মনের মধ্যে দগদগে ঘা আরো বিষাক্ত বড় হচ্ছে।  বাবা কৈলাস দাস আবারও  বললো , আঁরার  কর্তব্য আঁর তুন করিবদে আরি। তুঅর  বিয়াৎ আঁরা আছিলাম নে ? আঁরা নও  জানি ।

                  তার অজান্তে অনুষ্ঠানের জন্য হল ঘর ভাড়া করে অন্যত্র কৈলাস ব্যবস্থা করেছে । বর শিক্ষকতা করে।  কৈলাসের পরিচিত ব্যবসায়ী বন্ধুর ছেলে রাজীবের সাথে । অর্থ -দান -সামগ্রীর লোভে একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে এই বিয়েতে রাজী হয়েছে। তবে হ্যাঁ , তাকে অবগত করানো হয়েছে,  ভালোবেসে একজন অপরিচিত ছেলে নিয়ে গেছে ঠিকই কয়েকদিন পরে তাকে ছেড়ে চলে যায় । তার যে বাচ্চা মেয়ে আছে একথা ঘূনাক্ষরে বলেনি।        

                            প্রাসাদোপম অনুষ্ঠান বাড়ি । আলোর ঝলমল চোখে মনে দাগ কাটবে । অতিথি অভ্যাগতদের পর্যাপ্ত উপস্থিতি । ভুরি ভোজের আয়োজন।  উপস্থিত বিয়ে বাড়ির সকলের স্বস্তির  ও তৃপ্তির ছাপ। বিপুল অর্থ ব্যয়ে  বিপুল আয়োজনে টুম্পার বিয়ের পিঁড়িতে পদার্পণ । শুধু বাবা-মায়ের মনে মেয়ের মানসিক যন্ত্রণা লাঘবের এই প্রচেষ্টা । রাত্রি তৃতীয় প্রহরে বিয়ের লগ্ন । রাঙাচেলি  পরিহিত অপরিসীম স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিত লাল বেনারসি ঝলমলে ওড়নায়  আবৃত  টুম্পা পানে আচ্ছাদিত মুখ নিয়ে  বিয়ের পিঁড়িতে গেল ।

                                      ওদের বিবাহের  রীতি অনুযায়ী সূর্যোদয়ের পূর্বে বিবাহ বাসর ছেড়ে  কন্যা পতিগৃহে রওনা দেবে। শম্পা ততক্ষণে জেগে গেছে।  উত্তরীয়ের বন্ধনে রাজীব ও টুম্পা যখন পুষ্প সাজে সজ্জিত গাড়িতে উঠতে যাবে ; শম্পা সজোরে, -- মা --মারে আঁই যাইয়ুম ।  সে চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । তাকে ধরে রাখা যায়নি ।

                                                ---- ওটা ওকে খুব ভালবাসত যে ,  ওর পালিত মেয়ে । ও মা হারা ও কাঁদুক নিজের নয় তোমরা যাও । বলে অবশেষে শম্পার দিদা  কোলে তুলে নিল ।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.