প্রথম সাক্ষাত
প্রকাশ চন্দ্র রায়
-দাদা, আমার জন্য দুটো খাতা আর একটা কলম আনবি।
--দিলি তো যাত্রাটা মাটি করে!
ছোটবোন নন্দিতার কথায় কৃত্রিম বিরক্তি প্রকাশ করলো নিরঞ্জন কুমার। পকেটে একটা টাকাও নেই যে, রিক্সা ভাড়া করে টিউশনিতে যাবে, চিন্তায় মাথা ঘুরছে তার;
দাড়ি-গোঁফের জঞ্জালে কেমন যেন ইসলামীদলের পাতি লিডারের মত হয়েছে মুখমন্ডলের দৃশ্য। আজ পাঁচদিন যাবত সেভ করার পয়সাটাও জুটছে না। চা-পানের দোকানে বেশকিছু টাকা বাকী পড়েছে এরপরেও বাকীতে খেতে চাইলে তাকে আর যা হোক ভদ্রলোক ভাবা যায় না-আত্ম-সমালোচনায় মনোযোগী হল নিরঞ্জন।
বাসা থেকে ফরিদাদের বাসায় পৌঁছতে দশটাকা'র মামলা অথচ পকেট এখন গড়ের মাঠ। বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অংক করায় সে ক্লাশ নাইনের ছাত্রী ফরিদাকে আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত পড়ায় আরেক ছাত্র রিন্টুকে। আজ মাসের পঁচিশ তারিখ-টিউশন ফি-র টাকা হাতে পেতে এখনো সপ্তাহখানেক দেরী তো হবেই। এতসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে হেঁটেই চলল সে।
ছোট বোন নন্দিতা বেশ আদরের আর ভীষণ দাদাভক্ত-যা কিছু আবদার সব দাদার কাছে। এত আদরের বোনকে ছেড়ে অন্যকে পড়াতে যায়, এটাও তার বিবেককে খোঁচায়। নন্দিতা অবশ্য বেশ ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী, ক্লাশ এইট এ পড়ে জিলা স্কুলে।
ফরিদাদের বাসায় পৌঁছলো কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটায়। ফরিদার আম্মা বিস্কুট চানাচুর আর চা দিতে দিতে বললেন,
-বাবা নাও; বেশীকিছু দিতে পারলাম না, মাসের শেষ তো, তোমার আঙ্কেলের এখনো বেতন হয়নি তাই।
- যাহ্ শালা! আন্টির কথাটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল আরও। মনে মনে ভাবছিল সে,
- আন্টিকে বলে এডভান্স কিছু নিয়ে নিবে;
- এ কথা শোনার পরে সে আশাও ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল।
-আপনাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন স্যার?
-ফরিদার কথায় চমক ভাঙলো নিরঞ্জনের। উত্তর দেওয়ার আগেই মোবাইলের রিংটোন বাজতে লাগলো ক্রিং ক্রিং ক্রিং,
-অন্যমনষ্কভাবেই রিসিভ করলো ফোন, রিসিভড নাম্বারটা চেক করবার প্রয়োজন বোধ করলো না আর।
-হ্যালো, রঞ্জন,আমি রীতা বলছি.শোন,আমরা ট্রেনে করে ডোমার যাচ্ছি, এখন পার্ব্বতীপুরে আছি,একঘন্টার মধ্যেই লীলফামারী স্টেশনে পৌঁছবো। সেখানে ঘন্টাখানেক ব্রেক দিবে ট্রেনটা সেই সুযোগে প্রথম সাক্ষাতটা সারতে চাচ্ছি তোমার সাথে-তুমি ছয়টার মধ্যেই নীলফামারী স্টেশনে চলে এসো প্লিজ.আমার আর তর সইছে না!
-তোমার জন্য চমৎকার একটা গিফট এনেছি ঢাকা থেকে.আর শোন, সঙ্গে মা আর ছোটভাই রিপন আছে কিন্তু, মা'কে তোমার কথা বলেছি সব, বলেছি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড নিরঞ্জন, ওর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত করবো। মা খুব খুশি হয়েছে,সে-ও খুব আগ্রহী তোমাকে দেখার জন্য।
-আর হ্যা, কোন একটা হোটেলে চা-টা খাবো আর কথা বলবো,বিলটা কিন্তু তুমিই দিও, কোনক্রমেই মা'কে বা আমাকে দিতে দিও না। মা কিন্তু ভীষণ খুশি হবে তাতে। রাখলাম, সাক্ষাতে আলাপ হবে বাইইই।
রীতার কথা শুনে যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হল নিরঞ্জনের মাথায়। হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ, তারপরে রীতার নাম্বারে ডায়াল করলো, ফোনে ব্যালান্স নেই! বিক্যাশ একাউন্ট চেক করলো পাঁচ টাকা এন্ড সামথিং।
-কে ফোন করছিল স্যার? আপনাকে কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে!
-আনুপূর্ব্বিক সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সে ফরিদাকে,শুধু বলল না যে পকেটে একটা টাকাও নেই।
-খিল খিল করে হেসে উঠলো ফরিদা।
--আপনাকে ঠিক হিমুর মতই লাগছে স্যার। খোঁচা খোঁচা গোঁফ-দাড়ি, নীলরঙের পাঞ্জাবী আর মিল্কী হোয়াইট কালারের জিন্সে যা দেখাচ্ছে নাহ!
দুশ্চিন্তার মাঝেও ঈষৎ হেসে ফেলল নিরঞ্জন, বলল,
-হিমু'র পাঞ্জাবী হলুদ রঙের।
--ঐ আর কি,তবে আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে যাবো স্যার, আপনার বন্ধুকে দেখার খুউব ইচ্ছে হচ্ছে আমার।
-ওরে সর্বনাশ!
-ফরিদাকে পাত্তা না দিয়ে তড়িঘড়ি করে মেইনরোডে চলে এলো সে। টেবিলের উপড়ে রাখা কাপের চা ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে আর ফরিদা অবাকচোখে তাকিয়ে থাকলো নিরঞ্জন স্যারের গমন পথের দিকে-।
মেইনরোডে উঠে খুবজোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো নিরঞ্জন। দিশেহারা হয়ে পাঞ্জাবী আর প্যান্টের পকেটগুলো হাতড়াতে লাগলো, অলৌকিকভাবে যদি কিছু টাকা জুটে যায় এই আশায়। প্যান্টের হিপ-পকেটে কি যেন হাতে ঠেকলো ঠিক টাকার মতই,ধ্বক করে উঠলো হৃৎপিন্ড। চট করে বের করে এনে মেলে ধরলো চোখের সামনে, মায়ের নাম লেখা প্রেসক্রিপশন! তিনদিন হল ঔষধগুলো কিনতে বলেছিল মা,অর্থাভাবে আজও কেনা হয়নি। হায় ভগবান! এখন সে কি করবে! কষ্টকর উত্তেজনায় ও উৎকন্ঠায় দুচোখে জল আসার উপক্রম হল তার। কোনমতে সামলে নিয়ে মাতালের মত ঢুলতে ঢুলতে সামনে এগুতে লাগলো।
হঠাৎ করে সোনিয়া আন্টির কথা মনে পড়ে গেল। ইস্, ঐ আন্টিটা যদি আজ পর্যন্ত থাকতো, তাহলে এই অবস্থায় পড়তে হতো না তাকে, যখন তখন হাত পাতলেই দু'চার শ পাওয়া যেত অনায়াসে। ওনার মেয়েকে পড়ানোর টাকাটা সময়ের আগেই দিয়ে দিতেন কাছে ডেকে। দূর্ভাগ্য আমার! ওনার স্বামী এখন এ,ডি,সি হয়ে কুড়িগ্রামে আছেন। আন্টিরাও ওনার সাথে ওখানে থাকেন। আন্টির নাম্বার তো সেভ করাই আছে.দিবে নাকি একটা কল, না থাক।
সামনে সুবোধ শীলের সেলুন দেখে হুট করে ঢুকে পড়লো নিরঞ্জন, বলল,
-সুবোধ ভাই, ঝটপট সেভটা করে দাও তো।
-কাচুমাচু করে সুবোধ বলল,
--দাদা আগের কিছু টাকা পাওয়া যেত।
-আজকেও নেই,সেভ করে দিবি কিনা বল?
সেভ চলাকালীন ভাবছে নিরঞ্জন, রীতা যদি গিফট নিয়ে আসে, সে তবে খালি হাতে যায় কীভাবে?
বুক পকেটে রাখা মোবাইলে মেসেজ টোন বাজলো, বিরক্ত হলো নিরঞ্জন,
-ধুর! কিসের এত মেসেজ আসে রে!
-মাথা ঘামালো না মেসেজটাকে নিয়ে। সেভ শেষে উঠে দাঁড়ালো আর ঠিক সে মুহুর্তে রিং টোন বাজলো ক্রিং ক্রিং ক্রিং..
-রীতার কল ভেবে উৎকন্ঠিত হয়ে উঠলো মন তার। কৌতুহল নিয়ে দেখে চমকে উঠলো, এ যে সোনিয়া আন্টির কল। তাড়াতাড়ি রিসিভ করে ছালাম দিল। ওপাশ থেকে আন্টি বলল,
--কেমন আছো বাবা নিরঞ্জন?
বাধ্য হয়েই মিথ্যে বলতে হল তাকে,
-ভাল আছি আন্টি।
- আন্টি বললেন,
- -তোমার ছাত্রী তো গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে বাবা,
গতকাল রেজাল্ট বেরিয়েছে তা তো জানোই,কিছু টাকা পাঠালাম তোমার বিক্যাশ নাম্বারে, মিষ্টি খেয়ে একসেট সার্ট-প্যান্ট কিনে নিও আর ওর জন্য দোয়া করিও।
আকস্মিক আনন্দে ধ্বক্ ধ্বক্ করে লাফাতে লাগলো হৃৎপিন্ড। কথা শেষ করে রিসিভড মেসেজটা অন করে দেখলো ক্যাশ ইন টাকা-১৫৫০-।
সময় তখন বিকেল পাঁচটা ত্রিশ মিনিট।★
১৬/০৫/২০১৯/বৃহষ্পতিবার।