(বাবা দিবসের গল্প)
"রংপুর-যমপুর"
প্রকাশ চন্দ্র রায়
আমি রংপুরে যাবো,আমি রংপুর শহর দেখবো। প্রতিদিন আমার কান্না-কাটি আর প্রবল জেদের কারণে হুট করে এক বিকেলে বাবা সম্মত হলেন আর বেশ জোরালো কণ্ঠে বললেন,-আচ্ছা চল,আজ তোকে রংপুর শহর দেখিয়ে আনি তবে একটা শর্ত আছে।
-বাবা'র এহেন জোরালো বাক্য শুনে আমি তো হতবাক!
-এ ব্যাটা বলে কী রে ? এতদিন এত এতবার কান্না-কাটি,জেদা-জেদি করে করে পাড়া মাথায় তুলেছিলাম তাতেও বাবা সম্মত হননি আর আজ এই শেষ বিকেলে আমাকে রংপুরে নিয়ে যেতে রাজী হলেন!
-কেন?কেন?ব্যাপারটা কী?
- ক্লাশ থ্রী-র ছাত্র আমি,তবুও ভাল ছাত্র বিধায় যথেষ্ট চালাক-চতুর ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি যে,রংপুর-বহুদূর। এলাকার লোকজন রংপুরকে বলতো যমপুর।
- সে বয়সে মাইল-কিলোমিটারের হিসেব জানতাম না,শুধু জানতাম যে রংপুর-বহুদূর,রংপুর মানে যমপুর। যাহোক দ্বিধান্বিত মনে বাবাকে বললাম,
-কী শর্ত বাবা? একটা কেন?এক'শ শর্ত মানতে রাজী আছি,তবুও আমি রংপুরে যাবো।
-ইতস্ততঃ করে বাবা বললেন,
--কোনপ্রকার গাড়ীঘোড়া তো নেই,বেশী টাকা-পয়সাও নেই, হেঁটে হেঁটে যেতে হবে আর চকলেট বিস্কুট ও একটামাত্র মিষ্টি ছাড়া অন্যকিছু খেতে বা কিনতে চাইবে না।
-তথাস্তু বাবা,তাই হবে। কিচ্ছু কিনতে চাইবো না,কিচ্ছু খাইতেও চাইবো না শুধু আমি রংপুর শহরটা দেখেই চলে আসবো।
-আমার মুখে সংস্কৃত ভাষার "তথাস্তু" শব্দটা শুনে,ছেলের পাণ্ডিত্যে আপ্লুত হলেন বাবা। মুচকী হেসে আর মৃদু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে রেডি হতে বললেন।
বাবা'র কথা শুনে আবেগে আপ্লুত আমি ঝটপট করে রেডি হয়ে নিলাম। খাকী কাপড়ের ইংলিশ হাফপ্যান্ট আর ব্লু-কালার হাফশার্ট পরে বাবা'র হাত ধরে হেঁটে হেঁটে চললাম রংপুর অভিমুখে।
বোধহয় ঘন্টাখানেকেরও আগেই পৌঁছলাম গিয়ে রংপুর শহরে,ততক্ষণে বেলা ডুবে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে।
স্বপ্নের শহর রংপুর দেখেই আমার আক্কেলগুড়ুম!
হায়!হায়! এ কেমন চেহারা রংপুরের? ছাল উঠা হেরিংবণ্ডের রাস্তার পাশে টিনের চালার কয়েকটা দোকানপাট,কেরোসিনের কুপি আর মশাল জ্বালিয়ে চলছে বেচাকেনা!
রংপুর যদি যমপুরই হয় তো এত কম সময়েই বা আসলাম কেমন করে। মনের দ্বন্দ্ব যাচ্ছেই না আমার! বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে একা একাই ঘুরে বেড়াতে লাগলাম স্বপ্নের রংপুর শহরের অলিতে-গলিতে।
মনের খটকা যাচ্ছে না আমার,এটা কেমন জেলা শহর! এর চেয়ে আমাদের থানা শহরটাই তো অনেক ভালো,মহকুমা শহর নীলফামারী তো আরও ভালো,আরও উন্নত। মনের কৌতুহল বাড়ছে ক্রমশঃ!
না! এটা রংপুর শহর হতেই পারে না!
রাস্তার পাশের মিষ্টির দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছেন বাবা,
-এ্যাই বাবু,এসো এসো মিষ্টি খাবে এসো
- আর পাশে দাঁড়ানো একজন লোককে ফিসফিস করে কী কী সব যেন বলছেন।
- লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। সন্দেহের দোলায় দুলতে দুলতে বাবার কাছে যাচ্ছি,পাশকেটে যাওয়া দু'জন লোকের কথাবার্তা কানে এলো,ওদের একজন অপরজনকে বলছে,
- -রংপুর শহর এখান থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে।
কথাটা কানে আসতেই নিশ্চিত হলাম যে,এটা রংপুর শহর নয়,এটা এলাকার কোন একটা ছোট্ট বাজার।
বাবার হাঁকডাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে মিষ্টির দোকানের সামনে এলাম। বাবার কাছে দাঁড়ানো কাকুটা রহস্য করে বললেন,
-কী রে বাবু,রংপুর শহর দেখা শেষ হলো?
-দৃঢ়চিত্তে কাকুটার কথার উত্তর দিলাম,
--এটা রংপুর শহর নয় তো কাকু!
- রংপুর নয় তো এটা কী রে বাবা? মৃদু হাসি দিয়ে বাবা বললেন।
- আমি আঙুল দিয়ে মিষ্টির দোকানে টাঙ্গানো সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম,
- -পড়ে দেখুন কী কী লেখা আছে।
ছেলের মুদ্ধিমত্তার পরিমান বুঝতে পেরে গর্বিত অথচ লজ্জিত বাবা'ই বললেন,
- আচ্ছা,আচ্ছা,তুমিই পড়ে শোনাও তো দেখি,কী কী লেখা আছে সাইনবোর্ডে।
বাবা'র চালাকী বুঝে ফেলার আনন্দে,গড়গড় করে পড়ে ফেললাম সাইনবোর্ডের লেখাগুলো,
"অপূর্ব মিষ্টি ভান্ডার"
অবিলের বাজার,
থানা-কিশোর গঞ্জ:
মহকুমা-নীলফামারী।
জেলা-রংপুর।
রচনাকাল-২০ জুন ২০২১,বাবা দিবস।