অপেক্ষমান ভগবান | প্রকাশ চন্দ্র রায়

 



অপেক্ষমান ভগবান

 প্রকাশ চন্দ্র রায় 




বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো,এখনো ওবাড়ী থেকে কেউ এলো না ডাকতে। ক্ষুধার চোটে পেটের নাড়িভুড়ি সব মোচড়া মোচড়ী শুরু করে দিয়েছে। 
আর কত অপেক্ষা করা যায়! সেই সাত সকালে কিছু মুড়ি চিবিয়ে এক মগ নুন চা খেয়েছে সে, এ যাবত চার চার বার আমাশয় মলত্যাগ করে এসেছে। 
পেটে খাদ্যাংশ কিছু অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না। 
ওবাড়ীতে ছোটভাই হরিপ্রসাদের মেয়ের জন্মদিনের উৎসব, বাদ্য বাজনা, খাওয়া দাওয়ার মহোৎসব চলছে। দূর-দূরান্তর থেকে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবেরা এসে খেয়ে খেয়ে যাচ্ছে। অন্তত শ'দুয়েক রঙিন কার্ড বিতরণ করেছে ব্যাংক কর্মকর্তা ছোটভাই হরিপ্রসাদ। 
তাকে কোন কার্ড দেয়নি বা মৌখিক নিমন্ত্রণও করেনি। তাতে কি হয়েছে ! 
একই মায়ের পেটের বড় ভাই সে, তাকে কেন কার্ড বা নিমন্ত্রণ করতে হবে! নিশ্চয়ই একবার এসে ডেকে নিয়ে খাওয়াবে। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে-ই তো রিক্সা-ভ্যান চালিয়ে চালিয়ে লেখাপাড়া শিখিয়ে এতবড় অফিসার করেছে হরি'কে। 
থানা শহরের এক কোণায় প্রায় বিঘা দুয়েক জমিতে বাড়ী ছিল তাদের,তার অর্ধেক'ই প্রায় বিক্রি করতে হয়েছে হরিপ্রসাদের লেখাপড়ার পিছনে।
বাকী অর্ধেকের অর্ধাংশ এবং বড়ভাই ভগবান দাসের ভাগের অর্ধাংশ কিনে নিয়ে বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ী করেছে ব্যাংক কর্মকর্তা হরিপ্রসাদ দাস-বাড়ীর নাম "বিউটি ভিলা"। পরমাসুন্দরী স্ত্রী বিউটি রাণী'র নামে রাখা হয়ছে নামটি। শেষমেশ মাত্র তিন শতাংশ জমিতে ছোট্ট দু'খানা টিনের চালাঘর তুলে বাস করে আসছে সে-ভগবান দাস। একখানা চালা'তে চার্জার ভ্যান রাখা আর রান্নাবান্না চলে,অন্য চালা'তে স্ত্রী সুমতি বালা আর এগারো বছরের মেয়ে সুনীতি বালাকে নিয়ে দুঃখে কষ্টে রাত কাটায় আজ এগারো বছর ধরে। 
মেয়ে সুনীতি বালা'র জন্মকালে স্ত্রী সুমতি বালা'র সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ছোটভাই হরিপ্রসাদের কাছে নিজ অংশের অর্ধেক জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল ভগবান দাস। 
আজ সকালে সুমতি বালা মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ীতে গেছে,মনে করেছিল ভগবান দাসের মধ্যাহ্ন ভোজটা তো "বিউটি ভিলা"তে'ই হবে,কাজেই বাড়ীতে আর অনর্থক রান্না করা কেন। মা মেয়ে তো আত্মীয় বাড়ীতেই ভোজন সেরে আসবে,বাড়ীতে রান্না করার মতো সেরকম বাজার সওদাও নেই। 
তিনদিন পূর্বে এক্সিডেন্ট করে ভাঙ্গা ভ্যান আর মচকে যাওয়া ঠ্যাং নিয়ে বাড়ীতেই গড়াগড়ি খাচ্ছে ভগবান দাস। কাজেই নির্দ্বিধায় চলে গেছে তারা দুজন,সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে বলে। 
ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর ভগবান দাস উসখুশ করছে আর বারবার ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখছে-কেউ আসছে কিনা তাকে ডাকতে। 
এবার তাকাতে'ই ধ্বক করে উঠলো বুকের ভিতর হৃৎপিন্ডটা, ধড়ফড় করে উঠতে গিয়ে মচকানো পায়ে আর কোমড়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলো ও: বাবারে বলে। তারপর আস্তে-সুস্থে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দাঁড়ালো বাড়ীর দরজায়। 
সৌম্যকান্তি অবয়ব নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদরের ছোটভাই স্বয়ং হরিপ্রসাদ দাস। মুহূর্তের ভাবনাতেই মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ জানালো ভগবান। 
-সাব্বাশ ভগবান দাস! তোর ধারনা'ই ঠিক। ভাই কখনো ভাইকে ফেলতে পারে রে? হাজার হলেও সে ভাই,ভাইকে না ডেকে থাকতেই পারে না!
- ছোট ভাই এর কথায় চমক ভাঙ্গলো তার, 
- -এ্যাই দাদা, বৌদিকে ডাকো তো। 
-ওরা তো নেই ভাই, আত্মীয় বাড়ীতে গেছে,আমি খেলে'ই হবে-চল চল। 
--না দাদা, এখন গিয়ে লাভ নেই,খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। আমি এসেছি অন্য কারণে। 
কথা শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো ভগবান দাসের।থতমত খেয়ে বলল,
-তবে আর কি কথা রে ভাই? 
--বৌদি কালকে বলছিল,তোর নাকি এক্সিডেন্টে ভ্যানটা ভেঙ্গে গেছে,শরীরেও আঘাত লেগেছে খুব!
আবার আবেগের ঘনঘটা ঘটলো ভগবানের মনে। 
ইস্ ! এত ব্যস্ততার মাঝেও ভাই তার দুঃসময়ে খোঁজ খবর করতে এসেছে! ভাই বলে কথা! নিশ্চয় কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চায় সে। 
সত্যিই কোট এর ভিতর পকেট থেকে এক বান্ডিল পাঁচ'শ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে ধরলো হরিপ্রসাদ দাস,ভগবান দাসের দিকে। 
-এই নে দাদা,পঞ্চাশ হাজার টাকা,এগুলো দিয়ে ভ্যানগাড়ীটা ভাল করিস আর নিজের চিকিৎসাও করিস।
- টাকার বান্ডিলটা দেখে হার্টফেল করার মত অবস্থা বড়ভাইয়ের। কোনমতে তোতলাতে তোতলাতে বলল,এত টাকা! 
- -আরো পাবি দাদা,বলল। তোর বাস্তুভিটার জমিটুকু লিখে দিস আমাকে-রেজিষ্ট্রির দিন আরো পঞ্চাশ হাজার দেব।
কথা শুনে একদম থ মেরে গেল ভগবান দাস!
টাকাগুলো না নিয়ে,বোবা'র মত নির্বাক দৃষ্টিতে স্নেহের ছোটভাই এর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নতমস্তকে টলতে টলতে বাড়ীতে ঢুকে,মাথা ঘুরে ধুপ করে পড়ে গেল আঙ্গিনায়। 
পেটের ভিতর ক্ষুধার অনুভূতিটা এখন কেমন হচ্ছে, 
তা আর উল্লেখ করলো না।(সমাপ্ত)★
.
রচনাকাল-১১/০৯/২০১৮/ইং মঙ্গলবার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.